Thursday, February 11, 2010

তিন কন্যা-পর্ব ২

চরিত্র-তালিকা

১) বিপিন চন্দ্র
২) সুনয়না সেন
৩) রঙ্গলাল
৪) মোল্লা ফকিরুদ্দিন
৫) কাপালিক শ্রী শ্রী তর্কালঙ্কার আচার্য্য
৬) আচু
৭) ইলু-দা
৮) বিমর্ষ ঘোষ
৯) শ্যামা
১০) উদ্দালক গুহ
১১) এক্সট্রা ঃ দরদী পাগল, সিপিএম ক্যাডার, কোর্টরুম জনতা, চাপরাশী প্রভৃতি
১২) গেস্ট এপিয়ারেন্স ঃ ব্রিঞ্জল দাস, দুর্যোধন
.
.
.

(বি.দ্র. :- এই উপন্যাসটির গতিপ্রকৃতি প্রকৃতপ্রস্তাবে বিবর্তনের নিয়মে অগ্রসর হইবে; সেহেতু সম্পূর্ণ চরিত্র তালিকা দেওয়া সম্ভব নহে, পাঠকের সুবিধার্থে কেবলমাত্র আংশিক দেওয়া হইল। বিবর্তনের ধস্তাধস্তির মধ্য দিয়াই কাহারো উদ্ভব হইবে, কেহ মিসিং হইবে, কেহ বা টিকিয়া থাকিয়া ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জয়মাল্যটি গলায় পড়িবে। )

---



মোল্লা ফকিরুদ্দিন


বিপিন বাবু চাট খান বেশী, মাল খান কম বিপিনের মতে, তাত্ত্বিক আলোচনা ব্যাপারটি দক্ষিন ক্যালিফোর্নিয়ার সানি ওয়েদারে একটি লং ড্রাইভের সহিত তুলনীয় ২০ বৎসরের নিরলস অভ্যাস এই দুটি ভোকেশানেই তাহাকে একপ্রকার সাবলীলতা দিয়াছে তবু অপরিচিত টেরেন অসোয়াস্তি প্রসব করে পথভ্রান্ত চালক যে ডেস্পারেশান সহিত জি.পি.এস. খোঁজে, বিপিন বাবু অনুরূপ প্যানিকে উইকি হাতড়ে বেড়ান বিশ্লেষনের চাকু দিয়ে কাটা কোন পাহাড়ি পথ, বা অরিজিনাল রেফারেন্সের ডাউনলোড বাটনে লুক্কায়িত কোন আত্মঘাতী অতল খাদের সম্ভাবনা--এ সকলি পরিচিত এম্বুশিং সিম্পটম বিপিন সতর্ক হন স্টিয়ারিং এ তাহার হাত ঈষৎ কাঁপে এ হেন পরিস্থিতিতে বিপিন বাবু ৬০-৭০ এর বলিউডে ভিলেনের ডেনে অনুপ্রবেশকারী সৎ ও ইমানদার পুলিশ-অফ্সর বনে যান জনি ওয়াকারের পেয়ালা হস্তে, হেলেনের নৃত্য উপভোগ করিতে করিতে, ইহারা ইঙ্গিতপূর্ণ তির্যক হাসি দিতেন ঠিকই, কিন্তু মধ্যবিত্ত মরালস হারাইবার ভয়ে সুরা ওষ্ঠ-স্পর্শ করিতেন না উপরন্তু ধান্দা করিতেন, কি করিয়া ফুলের টবে দামী মাল টাস্পিল করা যায় বিপিনেরও ভয়, এই বুঝি বসে বসে DUI খাইয়া গেলেন একাডেমিক বাতেলার জগতে তাহার সাধের লাইসেন্সটি এই বুঝি খোয়া গেল তাহার লাইসেনশিয়াস নেচার তখন আর কোন কাজে আসিবে কি?


তাই এই সব সিচুয়েশানে বিপিন বাবু চাট খান বেশী আর, প্রতিপক্ষকে স্টাডি করেন


সমস্যাটা হয় যখন স্টাডির বিষয় হয় দাস ক্যপিটালের তিন ভলিউম অথবা মাও-লিন পত্র-সংকলন কলেজকাল হইতেই বিষয়ের গভীরতা, ব্যাপ্তি ও বৈচিত্র্যে বিপিন খেই হারিয়ে ফেলেন আজো তাহার অন্যথা হইল না প্রতিপক্ষের বিশালতা ও আয়তন তাহকে আচ্ছন্ন করিল কিন্তু একি! প্রতিপক্ষ তো কোন রচনা সমগ্র নয়, বরং পূর্বোল্লিখিত উদাহরন সহ সহস্র সহস্র পান্ডুলিপি একা মস্তকে ধারণকারী একটি মানুষ তাহার পরনে সাদা কুর্তা পাজামা ঢোলা ব্লেজার। মুখ ভর্তি দাড়ি মাথায় ফেজ টুপি চোখে রোষাগ্নি উদরে দু পেগ জ্যাক ড্যানিয়েলস আর মনে?


মারিঘেলা রচিত গেরিলা-ওয়ারফেয়ার বুকলেট হইতে আরোহিত ফান্ডা সমৃদ্ধ মনে? এক বহু-ব্যবহৃত এমবুশিং টেকনিক


বিপিন পড়িল একটু ধন্দে পাঠকের সাথে বিপিন-এর শেষ সাক্ষাত হইয়াছিল, হুগলী তীরের শ্যাওলাকীর্ণ গঙ্গাবক্ষে উপন্যাস প্রকাশনায় বিলম্বে অধৈর্য পাঠক, আপনারা এসিউম করিয়া লইয়াছিলেন, বজরার সেই ঝঞ্ঝা-মুখরিত দিন গুলির পর নায়কের জীবনে আর লিখিবার মত কিছু ঘটে নাই মূঢ় পাঠক! নিজ নিজ মান্ডেন এক্সিস্টেন্সের মাপক লইয়া আমার নায়কের মুল্যায়ণ করিতে আসিবেন না, প্লীজ! মিনতি করি সত্য হল ইহাই: পরবর্তী ঘটনাগুলির চমৎকারিত্ব ও আকস্মিকতা আমাকে এতটাই হতভম্ব করিয়ছিল, যে এ সকল ক্ষণ উহা হইতে উদ্ভুত ইম্প্রেশনগুলি এসিমিলেট করিতেই চলিয়া গিয়াছিল আহেম ;-)


সে যাহা হউক, কথা হইল কলিকাতায় আসিবার পর বিপিনের নিকট সময় ছিল না পোস্ট-মাস্টার রূপে তাহার খ্যাতির প্রচার প্রাচ্যেও ছিল বাম-বিরোধী বুদ্ধিজীবি শিবিরে বিপিন চন্দ্র একটি পরিচিত নাম বিপিন যখন গঙ্গায় সাঁতার দিতে ব্যস্ত, তখন আমাদের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী দিল্লী হইতে দুরন্ত বেগে একটি প্যকেজ বাগাইয়া ফুর্ফুরে মেজাজে ও ওয়েদারে হাওড়া ব্রিজের উপর লাল বাতি জ্বালাইয়া যাইতেছিলেন এবং বিপিনকে তৎক্ষণাৎ স্পট করিলেন মুহুর্ত বিলম্ব না করিয়া বিপিনের সাদর অভ্যর্থনার ব্যবস্থা করা হয়!


বিপিন দক্ষিন ক্যালিফোর্নিয়ার মানুষ বে-ওয়াচ তাহার রক্তে সি.এম. ভাবিলেন তাহার অভ্যর্থনাও হোক কোন অভিনব মার্কিন কায়দায়

সেই অনুসারে স্থির হইল, সবুজ সুইমস্যুট পরিহিত কতিপয় লাইফ-গার্ড বিপিনকে সযত্নে জলকেলি করিতে করিতে তীরে তুলিয়া আনিবে ইহার পর এক চ্যাম্পিয়ান আন্টি-কমির যোগ্য সম্মানে উহাকে স্কন্ধে তুলিয়া শহর পরিক্রমা করিবে সবুজ স্যুট দিগকে ডাইভ দিতে দেখিয়া বিপিনের মনে হইল সে পুনরায় আঙ্কল স্যাম এর স্বপ্ন-রাজ্যে ফিরিয়া যাইতেছে


কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই তাহার ঠাহর হয়, ইহারা সান ডিয়েগো বিচের পেশাদার কোনমতেই নয়, বরং এক একটি নেশাখোড় টি-এম-সি ক্যাডার অত্যন্ত বেদনার সহিত বিপিনের নেক্স্ট রিয়ালাইজেশান - ইহারা সবাই পুরুষ এক জনৈক ক্যাডারের ট্রান্সপেরেন্ট স্যুট হইতে প্রস্ফুটিত লাল ট্যাঙ্ক টপের আড়ালে পামেলা-সাইজ স্তন তাহাকে কিয়ৎকাল বিভ্রান্ত করে বটে কিন্তু উত্তোলন পর্বে সেই জনৈকের কন্ঠেই পরিষ্কার বাংলায় --'কি লদলদে পাছা মাইরি, তবে শ্রীলেখাদির মত না, আমি একবার ডামি দিতে গিয়ে তুলেছিলাম' (এবং প্রত্যুত্তরে বন্ধুর 'বাঁড়া ডালডাটা সঙ্গে আনবি তো' ) শুনিয়া বিপিন বাবুর মানসিক পদ-যুগল ধরণী স্পর্শ করে বিপিন চন্দ্রের কলিকাতা পদার্পণ সম্পূর্ণ হয়


এ হেন রাজকীয় সমাদরের পর বিপিনের এই সেমিনার, ঐ কনফারেন্সে গিয়া সময় কাটে বন্ধুরা তাহাকে ও! ক্যালকাটা-য় ডিনারে ডাকে, বিরুদ্ধ মতাবলম্বীরা ওপেন ডিবেট করিতে তাহাকে টাউন হলে আহ্বান জানায় সেই বিরোধী শিবিরের একজন নামজাদা প্রতিনিধি তাহার আজকের প্রতিপক্ষ ইসলামিক স্কলার জহর নায়কের নাম কে না জানে! এনার সাথে বিপিন এর ইন্টার্নেট ডিবেট সুপ্রসিদ্ধ শোনা যায়, এসবের কারণেই ফতোয়া লিস্টে চোষলিমার পরেই বিপিনের স্থান সত্যের পূজারী বিপিন এগুলোকে বিশেষ গুরুত্ব কোন দিনই দেয়নি জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য, তবু হিপোক্রিট কমিদের ন্যায় মুসলিম মৌলবাদের বিপদ হইতে চোখ ফিরাইয়া নিবে না সে কদাপি না চাড্ডি -হাড্ডি এক হইলেও না


সেই জহরের নাম্নার ওয়ান শিষ্য মোল্লা ফকিরুদ্দিন (ভার্চুয়াল ফোরামে ও জিহাদি রাপের দুনিয়ায মো-ফাক এলায়াসে যিনি অধিক পরিচিত) আজ তাহার সামনের চেয়ারে বিপুলের ধন্দের কারন অনেকগুলি প্রথমত উর্দু ইংরেজী দিয়া শুরু করিলেও দু'পাত্রের পর ফকির সাহেব শান্তিপুরি বাংলায় বাক্যালাপ শুরু করেন দ্বিজু রায়ের নাটকে শাজাহান যেমন বলিত বিস্ময় প্রকাশ করিলে ফকিরুদ্দিন ঘোষণা করেন, আফগান কমিউনিস্ট পার্টির আপিসে তাহার কিছুদিন আসা যাওয়া হয় সেখানে সরোজ দত্তর কবিতার পুস্্তু অনুবাদ পাইয়া, অরিজিনালটিকে ধরেন ও শীঘ্রই ভাষার প্রেমে পড়ে যান ক্রমে বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ ধরিবেন বিপিন আরো আশ্চর্য হন এই ভেবে, পাঁচ-ওয়ক্ত নমাজ পড়নেওয়ালা সাচ্চা মুসলমান, পবিত্র কোরানের প্রতি অক্ষর মাননেওয়ালা এক পায়াস মৌলবী, তামাম কলিকাতায় এই স্থান টিকেই বেছে নিল, ডিনার প্লেস রূপে! শেষে কিনা অলিপাব!


দ্বিতীয়ত, তর্ক করিতে করিতে বিপিন টের পায়, ইসলামের থেকে মার্ক্সবাদে মোল্লার জ্ঞান ও ইনক্লিনেশান বেশী বিপিনের ধন্দ ঠাউরিয়া মোল্লা জানান, উনি কাবুলে ঠান্ডা যুদ্ধের সময় আন্টি-সোভিয়েট সাবভার্সিভ ওপারেশন ইউনিটের তাত্ত্বিক বিভাগের হেড ছিলেন| মার্ক্সিসমকে থিওরিটিকালি পরাস্ত করিবার জন্য এসব নিয়ে এককালে প্রচুর চর্চা করেছেন উইথ আ সেন্স ওফ আইরনি বিপিন নোট করেন, মোল্লা বেশে মার্কসবাদি বুলি আউড়ে মোল্লা মার্স্কীয় প্যরাডাইমের মৌলবাদি দিকটাই কেমন উলঙ্গ করিয়া দিতেছেন তৃতীয় পেগান্তে বিপিনের মনে ধন্দ ও আইরনির সথে একটি নতুন অনুভূতি যুক্ত হয়-- ভয়! কিছুক্ষণ হল ফকির সাহেবের মেজাজ ও কন্ঠস্বর দুই-ই বড় তিরিক্ষি আকার ধারণ করিয়াছে জিভের সাথে জড়িয়ে গেছে ভাষা ঊর্দু-সাধু মিশ্রিত এক অদ্ভুত বাংলা তাহার কন্ঠে এবং প্রতি বাক্যের পর উচ্চৈ:স্বরে একটি ফতোয়া-প্রদান কারী (এমনি তার ডেলিভারির ধরন) ঊর্দু শ্লোক ভাষাগত কারণে বিপিন যাহা বুঝিতে পারে না, অথচ মনে হয় অতি-পরিচিত


'অবিশ্বাসী কাফির, এখন দেখ কি করিয়া তোমার নাদুস নুদুস এন-আর-আই শাইনিং পোদ মারিয়া হিন্দুস্তান-পাকিস্তান করিয়া দিই, ইনশাল্লাহ
রহমান আল রহিম বিসমিল আসফকুল্লা'


বিপিনের মনে পড়িল কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলায় বিসমিল প্রসাদ আর আস্ফকুল্লা দুজন বিপ্লবীর নাম

-'কাকোরি?'

-'ইমবেসিল আব্বাচোদ আমার নসিবে যদি থাকত তোকে কাটিন কাবাব বানাইয়া খাইতাম
'মহম্মদ ইলিয়াস মুজফ্ফর ভাসানী নাজিবুল্লাহ'


এই আপাত-অসংলগ্ন কিন্তু আদতে মনোজ্ঞ ও জটিল কথোপকথনটির ডিটেলস দিয়া পাঠকদের বোর করিব না কেহই এতে ইন্টারেস্টেড হইবে না ওয়েল, অল্মোস্ট কেহই এটি বলার কারণ, সে নিশিরাতে মধুশালায় অন্তত একজন ব্যক্তি--যাহার ইন্টারেস্টের মাত্রা ও প্রকৃতি সাধারণ মাপকাঠিতে বিচার করা ঠিক হইবে না পাঠক পাঠিকারা, আমাকে এই চরিত্রটি প্লীজ ডিস্ক্রাইব করিতে বলিবেন না কারণ আমি পারিব না নভেলে ইনি ফিরিয়া ফিরিয়া আসিবেন কিন্তু কভু সম্পূর্ণ রূপে ধরা দিবেন না আধো আলোছায়ায় তাহার সিল্যুয়েট ও চারমিনার-নির্গত লাল ধঁোয়ার রিং হইতে আমরা তাহার উপস্থিতি আন্দাজ করিব মাত্র, তাহার বেশী নহে এই ইল্যুসিভ ক্যারেক্টারকে আমরা আদর করে ইলু-দা ডাকতে পারি ইলু-দা কি করে, তাহার দর্শন কি, তাহার অতীত কোথা-- এসকল প্রশ্ন আদি অপার বিশ্ব রহস্যমালা সিরিজের টপ ফাইভে আসিলেও একটি বিশেষ ক্ষমতা-ধারী মনুষ্য-গোষ্ঠীর নিকট সিটার-তুল্য


ইলুদা ছাড়াও যারা সীনে আছেন, তাহারা হলেন অলিপাবের ওয়েটার-কুল


বহু দিনের অভ্যেস ও অধ্যবসায়ের জোরে অলিপাবের ওয়েটার মাত্রই এক অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার অধিকারী পশচার, সিগারেট ধরার স্টাইল, কাশির ধরণ, ও বডি ল্যাঙ্গুয়েজ এর নানান খুঁটিনাটির উপর ভিত্তি করিয়া ইহারা বলিয়া দিতে পারে যে কোন মাতালের পরিচয়


আপনি যদি তিরিশের দশকের কলিকাতার অলিপাবে গিয়া প্রশ্ন করিতেন, 'ওয়েটার, এখানে আইস, প্রমথেশ বড়ুয়ার ফিচার ও আন্দামানের একাকীত্ব লইয়া কোণার টেবিলে উপবিষ্ট কে ঐ আনমনা ভ্যাট সিকস্টিনাইন সিপ করিতেছে? কে ঐ হতাশ যুবা?' উত্তর আসিত 'ব্যর্থ প্রেমিক, স্যার'


আপনি যদি সত্তরের দশকের অলিপাবে গিয়ে প্রশ্ন করতেন, 'এই এদিকে আয়, খালাসীটোলা থেকে মাল তুলে এনে কোণার টেবিলে বসে 'জয় বাংলা' শ্লোগান দিচ্ছে, ওটা কে রে? উত্তর আসিত 'হাঙ্গরি কবি, স্যার'


আপনি যদি আজ ইলুদাকে দেখিয়ে তাকে প্রশ্ন করেন 'এই,দেখ তো, কোণার টেবিলে, স্ল্লাউচিং পোসিশানে বসে আছে, ঐ যে কাকে-ঠোকরানো খোঁচা দাড়ি,
খেকুড়ে মুখ বানিয়ে রেড লেবেল টানছে দেখেচিস?, কিরম একটা আন-সিওর হাব-ভাব, কিরম একটা জাম্পি নেচার, অল-টাইম চোখ ঘোরে যেন সিগনাল পেলেই পদাতিক সিনেমার ধৃতিমানের মত পুলিশ ভ্যান ব্রেক করে উত্তর কলকেতার সরু গলি দিয়ে একছুট লাগাবে? কে রে, জানিস কে? বলতে পারবি?'


হাসিমুখ ওয়েটারের প্রম্প্ট উত্তর ' দ্য আনসার লাইস ইন ইওর কোশ্চেন, প্রাক্তন নকশাল স্যার'


ইলুদা ফকির কে মনোযোগ সহকারে দেখিতেছিল ও ডেসপারেট ভাবে কিছু একটা সিগনাল করিতেছিল পাঠক, সুভাষ মুখুজ্জের 'ছেলে গেছে বনে' কবিতাখানি আশা করি পড়া আছে বারে বসিয়া রেনেগেড পিতার বিলাপ, অন্তর্দাহ, ও সর্বান্তে পুত্রের হস্তে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত পতাকা দেখিবার বাসনা ইলুদার চোখে সেই ফিরে আসার আকুতি তবে বন থেকে না, ধুমকি থেকে কিছুতেই কাজ হচ্ছে না দেখে ইলুদা তার প্রেসিডেন্সি জেলের দিনগুলির সময় হইতে সযত্নে রক্ষিত ও প্রতিপালিত হাড়-কাঁপানো কাশিটা কাশলেন



ফকিরের সম্বিৎ ফিরল ততক্ষণে আলোচনা অনেক দূর এগিয়ে গেছে ইসলামে সাম্যের ধারণা থেকে আভ্যন্তরীণ বাজারে কম্প্রাদোর বুর্জোয়ার প্রভাব পর্যন্ত বিপিন-এর বক্তব্য- বাজার বড় কঠিন জিনিস, মার্ক্সিস্টরা পঁুজিবাদের পতন প্রেডিক্ট করতে অক্ষম, কারণ বাজারের গতি-প্রকৃতি নির্ধারণ করা সহজ নহে বাজার...



তিতিবিরক্ত হইয়া ফকির বলিল 'তুমি বাজার দেখিতে চাও, আমি তোমায় বাজার দেখাইব কাল এই ঠিকানায় চলিয়া আইস, আমার লোক তোমাকে পিক আপ করিবে।' আর হ্যাঁ, তুমি কি মাছ খেতে ভালবাস?'



বিপিন বিদায় হইবার পর ইলুদা শ্যাডো হইতে বাহির হইলেন বিপিনের সীটে বসিলেন তাহার চোয়াল শক্ত, তাহার নয়নে তেজ
আনশিওর জাম্পি হাব-ভাব টা যেন এক কাশির যাদুবলে পিতা হইতে পুত্রে স্থানান্তরিত হইয়াছে ফকির টুপি খুলিল, পা ঘষিল ও কম্পিত হস্তে দাড়িতে হাত বুলাইল




মাছ ও বিড়াল


গ্রোসারি চেইনস, হোল ফুডসে বীতশ্রদ্ধ এন-আর-আই বিপিন চন্দ্র দেশের আভ্যন্তরীণ বাজারের বিশৃঙ্খলাপূর্ণ আবহাওয়ায় প্রাণ ভরিয়া নিশ্বাস নিলেন। ফকিরুদ্দিন বাজার দেখাইবে বলিয়াছিল, ফকিরুদ্দিনের লোক তাহাকে এন্টালী মার্কেটে আনিয়া ফেলিয়াছে। সে এক দিক দিয়া দেখিলে ঠিকই আছে, কিন্তু বিপিন এই অদ্ভুত রসিকতার কোন অর্থ খুঁজিয়া পাইল না।

ফকিরের চামচা বিপিনকে বাজারের এক কোণায় লইয়া গেল। এক বিশাল বপু মানুষ খড়গ-হস্তে একটি ইলিশ মাছের শিরচ্ছেদ করিতেছেন। গাত্রে নামাবলী, কপালে রক্ত-তিলক। বটির পার্শ্বে গাঁজার ছিলিম। ছিলিম হইতে নির্গত ধোঁয়া, বাজারের বাকি অংশের সাথে এক ধূসর মায়াবী আস্তরণ নির্মাণ করেছে।

বিপিনের হাসি পাইল। মৎস্য বলির এত আয়োজন সে পিতার জন্মে দেখে নাই। বলিদায়কের বাজখাঁই নাম বেদীর ঠিক উপরে এক লড়ঝরে টিনের হোর্ডিং এর শোভা বর্ধন করিছে ।
'কাপালিক শ্রী শ্রী তর্কালঙ্কার আচার্য্য'

কথা প্রসঙ্গে বিপিন জানিতে পারিল, একটি মাছ ভেট দিয়া ফকিরুদ্দিন সাহেব শুভ সম্পর্ক ও দীর্ঘস্থায়ী বন্ধুত্বের সূচনা করিতে চাহেন। গতকালের তর্কাতর্কির জন্য উনি বিশেষ অনুতপ্ত। বিপিনের ধন্দ কমিবার বদলে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাইল।


বাজারে ভ্রমিতে ভ্রমিতে বিপিন খেয়াল করিলেন না কখন সন্ধ্যা ঘনাইয়া আসিল। সাতটায় বিপিনের মনে হইল, ফেরা দরকার। জনশূন্য বাজার । বিপিন শক্ত হাতে ফকিরুদ্দিনের উপহার মৎস্যটি লইয়া পা বাড়াইল। কাপালিক মাছটির কপালে রক্ততিলক পড়াইয়া দিয়াছে।

এমন সময়ে পথ রোধ করিল একটি কালো বিড়াল।

'হুশ হুশ হুট'

বিড়াল অনড়।

'যা যা ভাগ'

এর উত্তরে বিড়ালটি অপ্রত্যাশিত ভাবে একটি আগ্রাসী ভূমিকা গ্রহণ করিল। সম্মুখস্থ পদযুগল উঁচাইয়া মৎস্যের দেহ হইতে ঘ্রাণ লইতে উদ্যত হইল। সুগন্ধে প্রীত হইয়া একটি গ্রেট লীপ মারিল। বিড়ালের বডি ল্যঙ্গুয়েজ যদি বঙ্গ ভাষায় অনুবাদ করা যাইত, তাহা অনেকটা এইপ্রকার দাঁড়াইত:-

'তুই কাট, আমার এই মছলি রানী পছন্দ হইয়াছে। আমি ইহাকে খাইব। তুই পথ দেখ'

ইহার পর যাহা ঘটিল তাহা ব্যাখ্যাতীত। বিড়ালের আস্ফালন দেখিয়া বিপিনের হাত শিথিল হইয়া অসিতেছিল ঠিকই, এবারে কি করিয়া কি হইল ঠিক বুঝা গেল না, বিপিনের করতল হইতে মাছটি পিছলাইয়া গেল। বিপিনের মনে হইল, মৃত মৎস্যটি এক অদ্ভুত যাদুবলে নিজ দেহে প্রাণ সঞ্চার করিয়া এক ডেলিকেট ম্যনুভারে তাহার বাহুপাশ ছাড়াইয়া নিল।

(গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া বিপিন দক্ষিণ ক্যালির রঙ্গময় দিনগুলি স্মরণ করিল। লস এন্জেলেসের ডান্স ক্লাবগুলিতে এপারেন্টলি সিঙ্গল ও বোরড মামনি দেখিয়া উত্তেজিত বিপিন কতিপয় দেশি বন্ধু সমভিব্যাহারে যখন পিছন পিছন আসিয়া টুকি মারার স্টাইলে স্কন্ধে হাত রাখিত। এবং পরের দিনের লাঞ্চটাইমে সফটওয়ের ডিপার্টমেন্ট হেড-কে ফাইল পরিবেশনের তরে জমিয়ে রাখা দঁেতো হাসিটি নির্দ্বিধায় খরচা করিয়া বলিত 'মে আই হেব আ ডান্স প্লিস?' অনতিবিলম্বে এই ডেলিকেট ম্যনুভারগুলি পরিলক্ষিত হইত।)


এখানেই শেষ নয়।

মাছটি তাহার ডেলিকেট মুড়োটি সযত্নে পশ্চাতে হেলাইল। লেজ ও মুড়োটি মাটিতে স্থির রাখিয়া সেক্সি পেটি খান ধরণী হইতে দু-ইঞ্চি শূন্যে তুলিয়া একটি সিম্পল এক্রোবাটিক ফিট পরিবেশন করিল । ইহার পর মুড়োটি লইয়া চার পাঁচ বার লেজ-এর গোড়াটি ছোঁয়ার প্রয়াস চালাইল। ইহার পর প্রায় ৫ মিনিট নো নড়ন-চড়ন।

অতঃপর মৎস্য চোখ মারিল।

বিপিন চক্ষু মুদিল। আবার খুলিল। মাছটি পুনরায় চোখ মারিল।

এবারে বিপিন মৎস্য সমীপে নতজানু হইয়া উপবেশন করিলেন। তিন চক্ষু একত্রিত হইল। বিপিনের হৃদয়ে একটি তার ছঁিড়িল। কোন কিছু ছঁেড়ার যে আনুষঙ্গিক ব্যথা থাকে, বিপিন তাহা অনুভব করিল। গভীর বেদনার সহিত বিপিন দেখিল সম্মুখের বস্তুটি মৎস্য, নারী নয়। তবু তাহার নয়নে বহু জনমের নারীত্বের সঞ্চিত কটাক্ষ-শর। কঁাটা বাছিয়া খেলে এ মাছের স্বাদ নেওয়া যাবে না।


বিপিনের মনে আশ হইল-- হায়, এ যদি এক ইচ্ছাধারী মৎস্য-কন্যা হইত। বিপিন স্থির করিল এইরূপ কোন নারী তাহার জীবনে আসিলে সে তাহাকে জাপটাইয়া ধরিবে। কাপালিক ও ফকির দের ডিভিয়াস জগত হইতে, নির্বোধ দাঁতক্যালানে দেশি বন্ধুদের জগৎ হইতে, শত যোজন দূরে লইয়া গিয়া তাহাকে নিজের মত ভালবাসিবে।


আর, তাহার নাম রাখিবে-

সুনয়না।



সুনয়না


কলিকাতা হাইকোর্টের দাপুটে উকিল সুনয়না সেন গতকাল নাইট আউট মারিয়াছিলেন, সন্ধে সাতটার আজানে তার নিদ্রা টুটিল। প্রথমেই ক্ষিপ্রগতিতে লেপ পাশ মুক্ত হইলেন। পাশ ফিরিয়া শুইলেন। তাহার পর কি মনে হইল, তড়িৎগতিতে ঘাড় হেলাইয়া একটি এবস ও একটি নি-টাচ সমাপন করিলেন।
সুনয়না স্থির করিলেন, শরীরকে তিনি দিনের কোটার অধিক মর্যাদা দিয়া ফেলিয়াছেন। অথচ, গতকল্যের ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে মন অধিক মনোযোগ দাবী করে।


সুনয়না ভাবিতে বসিলেন।


সুনয়না সুন্দরী বুদ্ধিমতী সফল। তিনটিই অত্যধিক মাত্রায়। সাধারণতঃ এ সকল গুণাবলী বেশ কয়েক বন্ধু, হাজার খানেক প্রেমিক ও লাখ খানেক ঈর্ষান্বিতা জেনারেট করিয়া থাকে। সুনয়নার ক্ষেত্রেও করিয়াছিল। তদুপরি একটি এক্সট্রা অনাকাঙ্খিত শ্রেণী-শত্রু । ইহার কারণ সুনয়নার পেশা। সিভিল ল'য়ের জটিল ও প্রেস্টিজাস জগতের একচ্ছত্র সম্রাজ্ঞী তরুণী সুনয়না বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কেস হ্যান্ডল করিয়া থাকেন। ইহার মধ্যে কিছু রাজনৈতিক। এই সব কারণে কখনো রাষ্ট্রযন্ত্রের কখনো বা শক্তিশালী বিসনেস গোষ্ঠির সহিত সুনয়নাকে সম্মুখ সমরে লিপ্ত হইতে হয়। সুনয়না দুঃসাহসী, ন্যায় বিচারের অন্তরায় কোন প্রতিষ্ঠান হোক বা কোন প্রভাবশালী ব্যক্তি, যুক্তি তর্কের সাইক্লোনে প্রতিপক্ষকে খড় কুটোর মত উড়াইয়া দেওয়া তাহার বাম হস্তের ক্রীড়া।

কিন্তু যুক্তি তক্কের বাইরেও যে একটি ব্যাড ইভিল ওয়ার্ল্ড আছে, সুনয়নাদেবীর ক্ষতিসাধনে যাহার বাসিন্দাদের মোক্ষলাভ -- এই কথাটি কোর্টের সিনিয়র শুভনুধ্যায়ীরা উহাকে বুঝইয়া পারে না। ওঁরা সুনয়নাকে সারভেলেন্স ও সিকিউরিটি সাজেস্ট করেন। ফিয়ারলেস ও ফিয়ারসলি ইন্ডিপিডেন্ট সুনয়না তাহা প্রত্যাখ্যান করেন। অগত্যা একটি বোঝাপড়ার জায়গা তৈরী হয়।

সাহা ইন্সটিটুট ও হাই কোর্টের যৌথ কোলাবরেশনে কলা মন্দির প্রেক্ষাগৃহে এক টপ সিক্রেট সম্মেলনে এক অত্যাধুনিক যন্ত্রের যুগান্তকারী আইডিয়া জন্ম লাভ করে। সাহা ইন্সটিটুটের বায়ো-ফিসিক্স ডিপার্টমেন্টের ভিসিটিং সায়েন্টিস্ট ব্রিঞ্জাল দাসের জবানীতে:

'ব্যবস্থা হউক, সুনয়না দেবীর লোকেশান কো-অর্ডিনেট মনিটার করা হইবে না। উনি কোথায় আছেন কেউ জানিবে না । কিন্তু কি করছেন জানা যাবে। যেমন ধরুন ওনাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে, উনি হাত-পা ছুঁড়ছেন। বা উনি ক্ষিপ্রগতিতে পালাচ্ছেন। এই সিগ্নাল গুলি আমাদের কাছে আসবে। কিন্তু কি করে?
সুনয়নার চোখের লেন্সে রিমোট সেন্সর ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। রিসেপ্টর থাকবে এক লাইভ ইলিশের চোখে। ইলিশটি থাকবে কোর্ট-আপিসের একটি স্পেশাল একুয়ারিআমে। লেন্স পরিহিত অবস্থায় সুনয়নার মোটর নার্ভ এর সমস্ত ইম্পাল্্স রিমোট সেন্সিং কতৃক ইলিশের ব্রেনে রিচ করবে । মোটর-ইমপালস কে এলেক্ট্রনিকালি কোড করে করে একটি ভার্চুয়াল সুনয়না সিমুলেট করার চেয়ে এরকম একটি বায়োলজিকাল কেরিয়ার শুধু কস্ট-এফেক্টিভই না, নয়েজ রেশিও-র দিক থেকেও অনেক গুণ একুরেট। ....'


আইডিয়ার অভিনবত্ব ভাব কাটিয়া গেলে সুনয়নার মনে হইল, স্বাধীনতা হরণের ইহা এক নূতন কৌশল বটেক! তথাকথিত শুভানুধ্যায়ীদের লইয়া তাহার অভিমত হইলঃ কতিপয় অবসর-প্রাপ্ত বৃদ্ধ যাহাদের নীরস জীবনে সোনালী বিকেলগুলি আজ আর নেই। জীর্ণ জীবন-খাতায় বাহারী পাতার অভাবে অপরের খাতা তাহারা শকুনের মত ঠুকরাইয়া বেড়ায়। ইহা চলিতে দেওয়া যায় না। সুনয়না সেই ধরণের নারী যাহার ইগো আর গোঁ দুই-ই বেশী। দায়িত্বজ্ঞানহীন আম্রু পেরেন্ট এর মত চিন্তাশিশুকে ক্রেশে একা একা খেলিতে দিয়া চলিয়া আসার পাত্রী সে নহে। বরং যত্নশীলা দেশি জননীর মত একশান লইয়া তাহার অনুসরণ করেন। সুনয়না সেই প্রত্যুষেই কোর্টরুম থেকে চুপিসারে মৎস্য তুলিল, কিন্তু উহা ডিএক্টিভেট করিবার উপায় তাহার জানা ছিল না। ব্রিঞ্জাল দাস এর ল্যাবে গাড়ী লইয়া যাইতে যাইতে তাহার ইন্টিউশান বলিল, আরো এক দায়িত্বশীল তাহার অনুসরণ করিতেছে। এন্টালী মার্কেটে সে নামিলে অনুসরণকারীও নামিল । ধরা না পড়িবার বিষম তাগিদে সুনয়না বাজারের দক্ষিণ-পূর্ব কোণায় একটি টিনের শেড-তলে আশ্রয় লইল। সুযোগ বুঝিয়া বিশ খানেক বিবিধ প্রকৃতির মাছের স্তূপের মাঝে নিজের সাত দিনের অলটার-ইগো গুঁজিয়া আসিল।

ওপর মহলে মাছ চুরি যাবার প্রতিক্রিয়া সে আন্দাজ করিয়াছিল। তাহার প্ল্যান ছিল, ব্রিঞ্জালের ল্যাব হইতে আসিয়া আবার উহা পুনর্স্থাপন করিবে। সে আর হইল কই। যাহা হউক, আপাতত সে মুক্ত। রিলিভড। অত্যাবশ্যক ও যুক্তিপূর্ণ চিন্তার স্তর হইতে স্কেলুলেটিভ ফ্যান্টাসি অভিমুখে কন্যা অলস অসাবধানী পদক্ষেপে পা বাড়াইলেন। ভাবিতে লাগিলেন, ইলিশটির কারেন্ট স্ট্যাটাস এখন কি হইতে পারে, হয়তো সে এখন একুয়ারিয়ামের ক্লোজড কেমিকাল-যুক্ত বন্ধ পরিবেশ ভুলিয়া নর্দমার প্রাকৃতিক দুর্গন্ধে এডাপ্ট করিবার প্রয়াস চালাইতেছে, হয়তো কোন বুভুক্ষু বিড়াল তাহার গায়ের ঘ্রাণ লইতেছে, শিকারের সুযোগ খুঁজিতেছে| সুনয়নার ওষ্ঠ-কোণে দুষ্টু-মিষ্টি হাসি খেলিল।

উপরি-উক্ত সকল চিন্তা স্পেকুলেশান ও কন্জেকচার নামাইতে সুনয়নার মিনিট পাঁচেকের অধিক লাগিল না। কারন সুনয়না, অ্যাস উই অল নো, ইজ আ ফাস্ট থিঙ্কার।


ইহার পর সুনয়না শায়িত অবস্থায় ঘাড় ঘুরাইয়া বেডরুমের দক্ষিণে অবস্থিত কাবার্ড মিররে দৃষ্টি রাখিল। যত না আপন সৌন্দর্যের প্রতি, তার অধিক আজিকার এডভেন্চার, ডেয়ারিং ও তার এই নবলব্ধ স্বাধীন-সত্তার প্রতি এক চটুল শ্রদ্ধার্ঘ্য স্বরুপ আপনাকে আপনি চোখ মারিলেন।

তক্ষুনি কল্পনার সেই বুভুক্ষ বিড়ালটির কথা তার মনে পড়ে গেল|
পা দোলাতে দোলাতে সুনয়না পুনরায় চোখ মারিলেন




আচু-ইলু সংবাদ


মধ্যরাত্রির কলিকাতার রাজপথে বিপিন চন্দ্র ত্রস্ত পদে একটি মাগাড়ে ইলিশ বগলে লইয়া যাইতেছেন। তাহার পশ্চাতে চার উদ্দাম বিড়াল।


কোথা হইতে ইহারা জেনারেট হইল কেহই জানে না। অদ্য রাত্রির অনেক ঘটনার মতই ইহাও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যলয়ের আধিভৌতিক বিভাগের সিলেবাস অন্তর্ভুক্ত।


প্রথমে কালো হুলোটি ছিল, তাহার পর কোথা হইতে অবিকল আর একটি তাহার পিছ্নে খাড়া হইয়া পড়িল। তহার পর লাইনে আর এক, তাহার পিছু আরো একটি।
বিপিন ভাবিয়া পাইল না, ইহাদের হইতে নিস্তার কি করিয়া পাইবে।


অবশ্য তাহাকে বেশী দূর যাইতে হইল না। আনন্দপালিত মোড়ে কপু-র একটি ভ্যান তাহার পথ রোধ করিয়া দাঁড়াইল। বিপিন চন্দ্র কে প্রাক্তন, নূতন কোন নকশাল ক্যাটিগরিতেই ফেলা মাওসেতুঙ্গের স্মৃতি সৌধের উপর মুত্রাঘাতের সামিল হইবে। তথাপি বিপিন বাবু রাষ্ট্রদ্রোহ ও মহামূল্যবান সরকারী সামগ্রী চুরির অভিযোগে গ্রেফতার হইলেন।


সুনয়না চোখের লেন্স খুলিয়া একটি সিগারেট জ্বালাইল। সেই মুহুর্তে শহরের এক বিয়েবাড়িতে বিজলী গ্রিল বাফের ঠিক পিছনে একটি কালো ধোঁয়া বড়ই উচ্চাকাঙ্খী হইয়া উঠিল। বিয়ের জৌলুস, শব্দ ও জমক হইতে অনেক দূরে, খাবার ডাস্টবিনের ঠিক পাশে এই একটি মাত্র স্পট যেথায় আলোক স্পর্শ করে নাই। সত্যান্বেষী পাঠক, আমরা ট্রেলটি-কে অনুসরন করিব না, উহার গন্তব্য ও রুট তো জানা। আমরা নাহয় সোর্স-টি কে ধরি। সোর্স বলিতে ফুল হাতা নীল কোঁকড়ানো শার্ট থেকে বেরিয়ে আসা একটি ক্লান্ত শীর্ণ হাত । সুনয়না একটি বেন্সন হেজেস ধরিয়েছিলেন, হাতটির হাতে চারমিনার।


সেই নি:সঙ্গ নির্বিকার চার্মিনারকে সঙ্গ দিছিল টিম টিম করে জ্বলা এক বিড়ি। বিড়ি পানকারীর হাতটি বাই কন্ট্রাস্ট, শক্ত ও মাংসল। বিড়ি ও চার্মিনার চাপা কন্ঠে কিছু আলোচনা করিতেছিল। গলার ওঠানামা, কাশির ধরণ ও গোপনীয়তার বাতাবরন দেখে ঠাহর হয় আলোচনার বিষয় বড় সাঙ্ঘাতিক। বাঙালীর ইতিহাসে শেষ এ প্রকার আলোচনা হইয়াছিল ২২ শে জুন, ১৭৫৭ মুর্শিদাবাদে জগৎ শেঠের গৃহে। অনেকে আবার দ্বিমত পোষণ করিয়া আমাদের হিপ্নোসিস সিনে ডা: হাজরা আর মন্দার বোসের স্মরণ করাইবেন। সে যাহাই হউক, দুই ষড়যন্ত্রকারী পরিত্যক্ত আবর্জনার পাশে মুদু স্বরে বাক্যালাপ করিতেছিল। দুষ্ট (অথবা রিফর্মড) মাকুদের মতে, আস্তাকুঁড় টি ইতিহাসের।


না চেনার মধ্যেই চার্মিনার কে চেনা। তাই ও নিয়ে আর একটি বাক্য নয়। বিড়ির ক্ষেত্রে অবশ্য অত সাবধানতা অবলম্বন করার কোন কারণ দেখি না। পাঠকের সুবিধার্থে বলা থাকুক, ইনিই হলেন প্রথম সিনের মোল্লা ফকিরুদ্দিন। ইনিই আবার কাপালিক আচার্য। অবশ্য এ তো মাত্র দু'টো হল। দেশ-বিদেশের শত্রু-মিত্র এনাকে ভিন্ন ভিন্ন নামে চেনে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ঘৃণ্য দালাল সি-আই-এর কাছে যিনি boozy the red, তিনিই আবার স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড-এর son of joe । ইন্টারপোলের আর্কাইভে ওর ফাইলের শিরোনামে 'দ্য ফিশারম্যান' নাম টি পাওয়া যাবে। আধা-সামন্ততান্ত্রিক উপমহাদেশের গোয়েন্দা-সংস্থা, র ও আই-এস-আই এর কাছে,অবিশ্যি উনি একটি শর্ট, সিম্পল, ও কিউট নামেই বেশী পরিচিত।

আচু- এক্রোনিম ফর 'আসলি চুতিয়া'। আমরা যথাসম্ভব এই নামটিই ব্যবহার করব।

ইলুদা বলিতেছিলেন:

-'হোয়াট ওয়াস দ্যাট অল এবাঊট! মোল্লা ফক্রুদ্দিন, মাই ফুট! ঐ বিভৎস ডিসগাইসে তোমাকে কি ঘ্যাস্টলি লাগিতেছিল তুমি জান? এন্ড দ্যাট বিয়ার্ড! অগ্নীশ্বর-এ উত্তম কুমারের পাকা চুলের থেকেও জালি মাল। যে কেউ তোমায় চিনতে পারত'

-'কিন্তু পেরেছে কি?

-'শোন, ছদ্মবেশের জগতে তুমি হলে শাহরুখ। যাই কর না কেন, সব্বাই বুঝে যায় ওটা তুমি।'

-'কিন্তু ইলু দা , শাহরুখের মত পাব্লিক সব কিছুর মধ্যে আমাকেই চায়, এই এঙ্গল টা ভেবে দেখেছেন?'

-'দেখ আচু তুমি ভাল বক্তা, ভাল লিখিয়ে, দেয়ার আর রিসনস হোয়াই ইউ আর হোয়ার উ আর। তা বলিয়া বেশী ঘ্যাম লইবার স্কোপ নাই। আমরা বিপ্লবী চাই, শো-ম্যান নয়, অলিপাবে অল দ্যাট বুলশিট অন আফগান পার্টি এন্ড দোজ ক্রেজি স্পেশাল এফেক্টস। ওগুলোর প্রয়োজন ছিল কি? তুমি সবসময় এত বাড়াবাড়ি কর কেন বলত?'

বকা খেয়ে আচুর গলা একটু আর্দ্র।

-'ইলুদা, চেয়ারম্যান বলেছিলেন, বিপ্লব মানেই বাড়াবাড়ি।'

-'আচু , রেভোলিউশান রুদ্রপ্রসাদের নাটক নয়, বিপিনের স্কাইপ নয়, রঙ্গলালের কবিতা নয়, ইট ইজ...' এবার দুজনেই একসাথে, মাথা নিচু করে... 'এন এক্ট ওফ ভায়োলেন্স বাই উইচ ওয়ান ক্লাস ওভার থ্রোস এনাদার।'

এক মিনিটের নীরবতা। ইলুদা যেটা ভাঙলেন।

-' আমাদের আগেই পুলিশ বিপিনের কাছে পৌঁছে গেল কি করে, সেটাই ভাবছি।' 'মাছ কনফিস্কেটেড?'

-'উইথ অল হিজ পোজেশান্স'

-'কিন্তু এখনো থানা থেকে কোন খবর আসেনি। সেটাই ভাবছি। ওয়ান ওয়ে ওর দি আদার সাম্থিং ইজ রঙ। তোমার মাছ পুলিশের হাতে পড়লে আমাদের প্লান বানচাল। অন্যদিকে পরীক্ষাগারে মাছ এর ই-আই ধরা পড়লে সে ক্ষেত্রে নগরপাল আমাদের বলে সাবধান করে দিত। অন্ধ্র থেকে রেড করিডোর বেয়ে যে নতুন রুই এর শিপমেন্টটা আসছে, ওটাও গাঁড়ে যেত।

'তার মানে হয়তো আসল মাছটা বিপিনের কাছে নেই, উইচ ক্যান ওনলি মিন-ইউ, উইথ অল ইয়োর রেটোরিক এস কাপালিক আচার্যি গট ক্যারিড এওয়ে এন্ড বাঙ্গলড আপ। যদি মাছটা বদলে গিয়ে থাকে!'


- 'উফফ! পুলিশের ক্যাচাল টা না হলে আমরা এতক্ষণে বিপিন কে মনিটর করতে পারতাম!'

- 'তুমি শিওর ও সিয়া?

-'হান্ড্রেড পারসেন্ট'

-'শোনো এখন কিছুদিন যাস্ট ট্রাই টু মেনটেন আ লো প্রোফাইল। টিল উই লোকেট দ্য ট্র্যাকার-ফিশ। জানি এটা তোমার কাছে খুব শক্ত ব্যাপার।'

-'ইলু দা একটা কথা বলব?

-'বল।'

- 'আমার এই হাই প্রোফাইলগুলি আছে বলেই তো কেউ আপনার আর আমার লোয়েস্ট প্রোফাইলটিকে সন্দেহ করে না, ওয়েল আক্ষরিক অর্থে হাইয়েস্ট, হি হি'

-'ইউ মিন... খ্যাক খ্যাক।'

-'খিক খিক'

-'খুকুশ খুকুশ খুক' ( কাশি ও হাসি মিশ্রিত এক অপার্থিব ধ্বনি)


হাসিতে হসিতে দুজনেই ঊর্ধ্বপানে চাহিয়া দুটি ভিন্ন সাইজের স্মোক- রিং ছাড়িল। ছোট চাকা কিছুটা পথ বড় চাকাকে চালাইয়া লইয়া গেল, তাহার পর দুটি চাকাই ডায়ামিটার বরাবর ইন্টার্সেক্ট করিল, এবং যাত্রাপথ রিসিউম করিল।


গন্তব্য ছিল আকাশ




দুর্গেশনন্দিনী


বিপিনের স্পেশাল সেল হইতে দশ ধাপ সঁিড়ি উঠে মেজানাইন ফ্লোরে নগরপালের বাসস্থান। দুটি লাগোয়া কক্ষ। বড় কক্ষটি সার্ভেলান্স ক্যামেরা, প্লেগ ফিল্টার, পার্সোনাল-এবিউস অটো-ডিস্ক্রিশান প্রভৃতি অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি শোভিত। দুই দ্বারপাল বাহিরে অষ্টপ্রহর পাহারায় নিযুক্ত। ছোটো কক্ষটি সরঞ্জামহীন, অনাড়ম্বর, পরিপাটি। সেই ঘরের মেঝেতে মাদুর পাতিয়া, বালিশে আধশোয়া হইয়া রিডিং ল্যাম্প জ্বালাইয়া শ্যামা তৎকালে গভীর মনোনিবেশে নভেল পড়িতেছিল।


পাঠকের সহিত এই নারীর সাক্ষাৎ প্রথমবার, তাই আসুন তাহাকে ভাল করিয়া নিরীক্ষণ করি। শ্যামা নগরপাল-কন্যা। মুখাবয়ব দেখিলে তাহাকে অপাপবিদ্ধ কিশোরী বলিয়া ভ্রম হয়। এক্ষণে সে বাম হস্তের উপর কপোল রাখিয়াছে। তাহার আয়ত নয়নের দৃষ্টি বইয়ের পাতায় স্থির সন্নিবদ্ধ, চোখের মণি ক্ষিপ্রগতিতে অক্ষরগুলির উপর ভ্রাম্যমাণ। শ্বাস দ্রুত পড়িতেছে। ওষ্ঠাধরে পর্যায়ক্রমে অপ্রত্যাশার বিস্ময় ও নিবিড় পরিচিতির অভিব্যক্তি ফুটিয়া উঠিতেছে। ব্যাকগ্রাউন্ডে এক বিরক্তিকর একটানা খুট খুট শব্দ হইতেছে, কিন্তু শ্যামার কোনোদিকে ভ্রূক্ষেপ নাই। এমন উপন্যাস সে আগে পড়ে নাই। ঔপন্যাসিক প্রতি বিজোড়-সংখ্যক পরিচ্ছেদে পাঠকের মনের অন্তঃস্থলটুকু পড়িয়া লইয়া আবার তাহা পাঠককেই উচ্চৈঃস্বরে পাঠ করিয়া শুনাইয়াছেন। এবং জোড়-সংখ্যক পরিচ্ছেদে পাঠকেরই পরামর্শ মোতাবেক একটি করিয়া নতুন চরিত্রের সৃষ্টি করিয়াছেন। বিস্ময়াভিভূত শ্যামার গাত্রে গুসবাম্পস হইতে লাগিল, মনে হইতে লাগিল এমন ডাইনামিক্স সে ইতিপূর্বে কোনো নভেলিস্টের সহিত ফীল করে নাই। এ যেন তাহার মনের প্রতিটি চাওয়া নিংড়াইয়া শব্দের মোহিনী জাল বুনিয়াছে।



কলিং বেল বাজিল। চাইনিজ টেকঅ্যাওয়ে হইতে ডেলিভারি বয় আসিয়াছে স্পেশাল সেলের বন্দীর নৈশাহার লইয়া। পাঠে বাধা পড়াতে শ্যামার ভ্রূকুঞ্চিত হইল। মনে পড়িল, আজকের ডিনার বন্দীকে পৌঁছানোর দায়িত্ব তাহার স্কন্ধে।
সঁিড়ি দিয়া নামিয়া কন্যা বিপিনের সেলাভিমুখে চলিল। নেপথ্যের খুট খুট শব্দটি বাড়িতেছে। বুঝিবা শ্যামার পদশব্দ পাইয়াই, বুঝিবা নিছক সমাপতন-- বেসমেন্টের সলিটারি সেলে বন্দী জনৈক পাগলের উদাত্ত দরদিয়া কন্ঠ শুনা গেল,


'কেন তারে ধরিবারে করি পণ অকারণ, মায়াবনবিহারিণী হরিণী'।


শ্যামার চোখের কোণে দুটি ভাঁজ পড়িল, মুখে চকিত হাসি খেলিয়া গেল। পাগলের ঘুম নাই, সে সদাজাগরূক। বিমর্ষর দুই দ্বারপালের অন্যতম, রিফর্মড কমি পর্ণদাস, আসিয়া তালা খুলিয়া দিল, শ্যামা বিপিনের কক্ষে প্রবেশ করিল। এক্ষণে সে একটানা শব্দটির উৎস অনুধাবন করিতে পারিল। বন্দী টেবিলের উপর কুঁজো হইয়া ঝুঁকিয়া পড়িয়া এক অতিকায় কীবোর্ডে টাইপ করিতেছে। সেই সিগনালে শয্যার পার্শ্বে দন্ডায়মান রোবোটাকার প্রসেসরে লাল নীল আলো জ্বলিতেছে, সঙ্গে সঙ্গে দেওয়ালের উপর প্রজেক্টেড মায়াবী সবুজ আলোয় উদ্ভাসিত জায়ান্ট স্ক্রীনে ডেনিম জ্যাকেট পরিহিত রাতজাগা-লাল-চোখো-উস্কোখুস্কো-চুলের একটি লোক মুখব্যাদান করিয়া নানারূপ অঙ্গভঙ্গি করিতেছে। শ্যামার চোখ বিস্ফারিত হইয়া উঠিল। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে কিশোরীর নুপূরের রিনিঝিনি তুলিয়া সে জিজ্ঞাসা করিল, 'ও কি? ও কি লিখছেন? আপনি লেখক?'



নারীকন্ঠ শুনিবামাত্র বিপিন চন্দ্র ধরমরিয়া উঠিল। ফিরিয়া দেখিল নওলকিশোরী, এক হস্তে ল্যাম্প অপর হস্তে চিকেন চাউমিন। ইন্সট্যান্ট ইম্পাল্্সে মাথাটা তাহার ঘুরিয়া গেল, চিন্তাসূত্র ছঁিড়িয়া পড়িল। মুহূর্তের মধ্যে ঘড় ঘড় শব্দ করিয়া প্রসেসর স্তব্ধ হইল, স্ক্রীনের দৃশ্যাবলী ফ্রীজ শটের ন্যায় মধ্যপথে থামিয়া গেল। মোহাবিষ্টের ন্যায় বিপিন বলিল, 'আমি..
আমি..মানে পপার.. মানে আমি ফিলসফার! আমি ফিলসফার! লেখাই আমার নেশা। তুমি পড়িবে? আমার পিডিএফ?'


নীচের ফ্লোরে একাকী পাগল ততক্ষণে গান ধরিয়াছে-

'ইস অঞ্জুমন মে আপকো আনা হ্যায় বার বার
দীওয়ারো দর কো গউর সে পহেচান লিজিয়ে'।





অতিথি


বিপিন অপেক্ষা করছিল। রাত জেগে, সেলের গরাদে হাত রেখে। সকাল সকাল নগরপাল বিমর্ষ বাবু নিজে এসে তাকে জানিয়েছিলেন, তার ডিফেন্স লইয়ার যোগাড় হয়ে গেছে। অপেক্ষারত বিপিন খানিকটা তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন। সেলের বাইরে বূটের শব্দে সেটি ভাঙল।


বিপিনের সেলাভ্যন্তরে আমরা গতকল্য সন্ধ্যায় একবার এসেছি, পাঠক। এবার দিনের আলোয় ভাল করিয়া পুনরায় দেখা যাক। ২০১১ পরবর্তী যুগে ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক বন্দীদের চাপ সামলাতে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে একটি নতুন এক্সটেনশান তৈরী হয় । তারই সাউথ মোস্ট কর্নারে বিপিন বাবুর বর্তমান ঘর-বাড়ী। বারো ফুট বাই বারো ফুট একটি সেল। এই ফ্লোরে এটিই সবচেয়ে বড় কামরা। সেখান থেকে ফ্লোরের উত্তর পর্যন্ত একটি প্রশস্ত করিডোর। করিডোরের দুই পাশে প্রায় ৩০ খানেক ক্ষুদ্র সেলে হাজার খানেক কমি ইঁদুর বন্দী। করিডোর যেখানে শেষ , সেখান থেকে একটা ছোট স্টেয়ার-ওয়েল ঊঠে গেছে মেন গেট অবধি। গেট এর উপর পর্দা। পর্দার উপর ভাগে উত্তরের দেয়াল - সিলিং এর মিড-পয়েন্ট একটি ওভাল শেপের প্রোজেক্টার। এই মুহুর্তেত প্রোজেক্টারের মুখ থেকে স্টেয়ার ওয়েল বেয়ে, করিডোরের ঠিক মাঝখান দিয়ে বিপিনের সেল অবধি একটি গাঢ় সবুজ রঙ্গের কার্পেট বিছানো হয়েছে। অতিথি এলেই এরকম হয়। এই মায়াবী পর্দা আসলে একটি লেসার বিম। তবে এ আয়োজন শুধু অতিথি খাতিরে নয়।


দিনভর কমি ইঁদুরদের অনর্গল কিচির মিচির, ও সেল টু সেল থুতু ছোঁড়াছুড়ির প্রতিযোগিতায় ফ্লোরের বাতাসে প্লেগ ভাইরাসের প্রাবল্য । বাইরে থেকে লোক আসলে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা খুব বেশী। ইস্ট জর্জিয়া ইউনিভার্সিটির অপটিক্স বিভাগের উদ্ভাবন এই লেসারটির সান্নিধ্যে ভাইরাস সার্ভাইভ করতে পারে না। তীব্র সবুজ আলো একটি এন্টি-কমি-প্লেগ বর্ম নির্মাণ করে দেয়, যার ভেতর দিয়ে অতিথি সুরক্ষিত ভাবে করিডোর বরাবর আসা যাওয়া করতে পারে।

অবশ্য এতে একটি সমস্যা আছে। মনুষ্য-রেটিনার সবুজ আলো সহ্য করার থ্রেশহোল্ড আছে। সেন্ট্রাল জেলের প্রোজেক্টারের তীব্রতা তার থেকে ১৫ গুন বেশী। এই বিপদ এড়াতে অতিথিদের একটি স্পেশাল কালো চশমা পরিয়ে দেওয়া হয় । আজকের অতিথির চোখেও তাই একটি কালো চশমা।
পরনে নীল ফ্লিস জ্যাকেট, কানে হেডফোন।


বিপিনের মানসচক্ষে শৈশবে পড়া ছোটদের বাইবেলে আলোর ঢেউয়ে নেমে আসা হালেলুইয়া গীত-রত দেবদূত দের কথা মনে পড়ে গেল। ওদিকে কিচির্মিচির বন্ধ। অতিথি দর্শন মাত্রই কমি ইঁদুররা যে যার গর্তে সেধিয়ে গেছে। অতিথি দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে আসছে, অথচ সেলের বাসিন্দাদের মনে হল স্লো মোশান। কবির ফোর্কাস্ট অনুযয়ী ঠিক এভাবেই 'লাস্ট সিনে ফিরিবে দিওয়ানা' । কিন্তু বাস্তবে ফিল্মের মত ব্যকগ্রাউন্ড বাজে না। যদি বাজত তাহলে অতিথির গেটআপ, ঘ্যাম, ও চশমার সাথে মানানসই কিছু ঝিন্চ্যাক শুনতে পেতাম। তার বদলে শোনা গেল, পূর্ববর্ণিত সলিটারি দরদিয়ার কন্ঠ। ৯০ এর দশকে বাংলাদেশের ফ্রাস্টু-সমাজে এই গানটি জাতীয় সংগীতের মর্যাদা পেয়েছিল।

'সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে!'

বাস্তবের ডানা কাটা দেবদূত এখন সেলের ঠিক সামনে। কার্পেট গুটিয়ে নেয়া হলে আগন্তুক চশমা খুলল। সবুজ আলো নিভল।

'এসসসস-সে গেছি'-- অতিথির ঘোষণা।
বিপিন তখনো সন্দিহান।

- 'বিপিন চন্দ্র?'

- 'হ্যাঁ'

-'আপনার কেসের প্রসিকিউটর সুনয়না সেন তো?' একটি ইঙ্গিতপূর্ন হাসি হেসে চোখ টিপল অতিথি।

-'হ্যাঁ কিন্তু..'

- 'আর কোন কিন্তু ফিন্তু না। রিলাক্স। আমি যখন এসে গেছি, ইউ ক্যান কনসিডার ইয়োরসেল্ফ'...

এইটুকু বলেই অতিথি চুড়ান্ত এলিগেন্টলি ব্যাকফুটে গিয়ে একটি কাল্পনিক ব্যাট দ্বারা একটি কাল্পনিক বলের প্রতিরোধ করে দেখালেন। জেলের নীরবতা ভেঙ্গে একটি ক্লিক শব্দ হল।

...'ডিফেন্ডেড!'

অতিথি তার বাক্য শেষ করলেন। বিপিন সভয়ে সবিস্ময়ে লক্ষ্য করলেন, অতিথির থুতনিতে দুটি পাকা বাল।

(ক্রমশঃ...)



No comments:

Post a Comment